জরায়ুমুখের ক্যানসার কেন হয়?

জরায়ুমুখে ক্যানসার নারীশরীরের একটি জটিলতম রোগ। কিছু ব্যবস্থা নিলে শুরুতেই এটি প্রতিরোধ করা যায়। আজ ১৪ সেপ্টেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৫১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার এপিডেমিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
প্রশ্ন : বিশ্বব্যাপী ক্যানসারের অনেক প্রাদুর্ভাব, বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ছে। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে এ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এখনকার পরিস্থিতি কী? আপনারা কী করছেন?
উত্তর : এই বিষয়ে ভালোভাবে কাজ করতে সরকার চেষ্টা করছে। ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে মহাখালীতে, সেখানে এ বিষয়ে সব ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। তবে এখনো সুযোগ-সুবিধা কম। ৩০০ বেড হয়ে গেছে, এরপরও এক হাজার, দুই হাজার বেড করলেও সারা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য এটা যথেষ্ট হবে না। এ জন্য যে কাজটি দরকার তা হলো বিকেন্দ্রীকরণ। আমাদের যে পুরোনো মেডিকেল কলেজগুলো আছে, সেখানে ক্যানসার বিভাগ রয়েছে। রেডিওথেরাপি বিভাগ রয়েছে। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ রয়েছে। পোস্টিংও রয়েছে। তবে একটু দূরের জেলাগুলোতে হয়তো সব সময় সুবিধা পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে সরকারের একটু নজর দেওয়া দরকার। বেসরকারিভাবেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। তবে এগুলো বেশির ভাগই রাজধানীকেন্দ্রিক।
আপনারা জানেন, ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী শেষ হবে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা)। সেটা শেষ হওয়ার পর নতুন যে লক্ষ্যমাত্রা শুরু হচ্ছে, তার মূল কথা হচ্ছে ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষ চিকিৎসা পাবে, টাকা থাকুক বা না থাকুক। এতদিন আমরা শুধু মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলেছি। তবে এখন নতুন লক্ষ্য, যার টাকা নেই সেও যেন চিকিৎসা পায়। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার কথা বলা হচ্ছে এখানে।
এখন আমাদের ধাপে ধাপে ক্যানসার চিকিৎসা নির্ণয়, প্রতিরোধ, চিকিৎসা সবগুলোকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিতে হবে। এটা কী সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার একটি সুন্দর পদ্ধতি বাংলাদেশে রয়েছে। আমাদের মেডিকেল কলেজগুলো আছে, প্রতিটি জেলায় সদর হাসপাতালগুলোতে সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি, শিশু সব বিভাগই রয়েছে। যে বা যারা ক্যানসার চিকিৎসার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত, সেখানে যদি একটি পদ সৃষ্টি করা যায় অনকোলজিস্ট বা ক্যানসার বিশেষজ্ঞের, তাহলে একটা জেলা পর্যায়ে চলে গেল; এবং উপজেলা পর্যায়ে আমরা যেটা করতে পারি, চিকিৎসা হয়তো সেখানে দিতে পারব না, তবে ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য যে সহজ পদ্ধতি আছে সেই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা যাবে। যেমন : জরায়ুমুখ, স্তন ক্যানসার এবং মুখগহ্বরের ক্যানসার – এগুলো যদি আমরা উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে সাধারণ মানুষ অন্তত জানল বিপদ সংকেতগুলো কী, কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ওখানে প্রাথমিকভাবে স্ক্রিনিং হওয়ার পর সে সদর হাসপাতালে গেল। সেখানে যতটুকু সম্ভব হয় হলো, বাকিটা মেডিকেল কলেজে গেল। শুধু খুব জটিল রোগীগুলো ঢাকায় আসবে। তাহলে সাধারণ মানুষ খুব কম খরচে এই চিকিৎসা নিতে পারবে।
প্রশ্ন : জরায়ুমুখের ক্যানসারের ঝুঁকির কারণগুলো কী এবং প্রতিরোধে করণীয় কী?
উত্তর : হিউম্যান পেপিলোমি ভাইরাস বলে একটি ভাইরাস রয়েছে যেটা জরায়ুমুখের ক্যানসার হওয়ার সঙ্গে জড়িত। এটাই মূলত দায়ী এবং এর সঙ্গে আরো অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
আমাদের দেশের জন্য কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে। জসীমউদদীনের ‘কবর’ কবিতার মতো ছোট বয়সেই আমাদের দেশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। যে সময় তার পুতুল খেলার বয়স। ওই সময় মেয়েটির বিয়ে হত, শারীরিক সম্পর্ক হতো, বাচ্চা হতো, ঘনঘন বাচ্চা হতো- এই যে জরায়ুর ওপর একটি চাপ; যার কারণে জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি ছিল।
বাংলাদেশে যদিও এখন মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যানসারটি এক নম্বর, তবে জরায়ুমুখের ক্যানসারের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ, তাদের মধ্যে যেহেতু এই ক্যানসার বেশি হয়; তাই এই বিষয় নিয়ে আমাদের বেশি কথা বলা দরকার।
অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া, বেশি বেশি সন্তান হওয়া, ঘন ঘন সন্তান হওয়া এবং অপরিচ্ছন্নতা, পুষ্টির অভাব এবং হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস – এগুলো মূলত বাংলাদেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের প্রধান প্রধান কারণ।
এখন বলি, প্রতিরোধ করার রাস্তা কী? প্রথমে মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে। প্রথম কথা হলো আপনার মেয়েসন্তানকে বাল্যবিবাহ দেবেন না। এর অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। আর জরায়ুমুখের ক্যানসারের সঙ্গে এর একটি সরাসরি সম্পর্ক আছে। সে জন্য বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে  সচেতন হতে হবে।
প্রশ্ন : তবে আমরা দেখছি শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে সচেতনতা যতো বেশি নিম্নবিত্ত লোকদের মধ্যে এই সচেতনতা তেমনভাবে আসেনি। যাদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির এই প্রচেষ্টা..
উত্তর : সঠিক কথা। শহরে শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা হচ্ছে। জরায়ুমুখের ক্যানসার নিয়েও হয়তো তারা জানেন। তবে নিম্ন মধ্যবিত্তদের কাছে যাওয়ার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এসব জায়গায় একটি প্যাকেজ থাকা দরকার। যেখানে এলে তারা যেন এই বিষয়ে কিছু বার্তা পায়। জরায়ু ক্যানসার, স্তন ক্যানসারে লক্ষণগুলো যদি সুন্দর করে বলতে পারা যায় বিভিন্নভাবে, তাহলে ভালো হবে। আর যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেন, তাদের যদি প্রশিক্ষণ দিতে পারি- তাহলে জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধ করা যাবে। জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। এই রোগ যাতে একেবারেই না হয় এরকম ব্যবস্থা করাও সম্ভব কিছু তথ্যের মাধ্যমে। সত্যি বলতে, শুধুমাত্র সচেতনতা দিয়ে রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এরপরের যে ধাপ, যদি ক্যানসার হয়েও যায়, তাও প্রাথমিক অবস্থায় যেন ধরা পড়ে। এ জন্য বাংলাদেশে এখন খুবই সহজ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এতদিন করা হতো প্যাপটেস্ট। জরায়ুমুখকে যন্ত্রের মাধ্যমে একটু উন্মুক্ত করে একটা কাঠির মতো স্পেচুলা দিয়ে জরায়ুমুখের ভেতরের অংশ থেকে একটু ঘুরিয়ে সেখান থেকে কষ নেওয়া হয়। সেটা নিয়ে কাচের  টুকরোর স্লাইড বানানো হয়, সেটাকে মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখা হয়, কোনো অস্বাভাবিক কোষ আছে কি না দেখার জন্য। পরীক্ষাটা খুব জটিল নয়। রোগীর কোনো কষ্ট নেই, ব্যথা পাবে না। কোনো রকম কাটাছেঁড়া নাই। তবে একটু খরচ রয়েছে। এটা করতে প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা লেগে যায়। এর জন্য আরেকটি সহজ টেস্ট করা হয়। একে আমরা ভায়া বলি। ভিজুয়াল ইন্সপেকশন বাই এসিটিক এসিড। এখানে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে স্লাইড দেখতে হবে না। এখানে তুলার সোয়াব স্টিক দিয়ে ৪ শতাংশ এসিটিক এসিডের মধ্যে ভেজাবো। এরপর জরায়ুমুখের অংশে স্পর্শ করব, কয়েক মিনিট অপেক্ষা করব। যদি সাদা দাগ পড়ে যায় তাহলে বুঝব ভায়া পজিটিভ। এটা আমি খালি চোখেই দেখব। তবে একটা কথা বলি ভায়া পজিটিভ মানে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, এর মানে নিশ্চিত সে ক্যানসারের রোগী সেটি নয়। তাকে তখন পরবর্তী আরো দুই একটা ধাপ রয়েছে পরীক্ষার, সেগুলো করতে হবে। আবার ভায়া নেগেটিভ মানে সারা জীবনের জন্য ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নন। বিশেষ করে যারা বিবাহিত নারী, তাঁদের অবশ্যই এগুলো করতে হবে।
প্রশ্ন : স্ক্রিনিংয়ের সুবিধা যেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং এর সুবিধা যেন মানুষ পায়। এর জন্য কী করা দরকার?
উত্তর : ভায়া টেস্টটা উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের যে চিকিৎসক, একজন নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী তাদের দিয়েও করানো যায় একটা গাইডের মাধ্যমে। এই পদ্ধতিটি যদি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে দিতে পারি, জরায়ুমুখের ক্যানসারের অবস্থার এখন যে পরিস্থিতি; সেটায় তাহলে পরিবর্তন হবে। একদম প্রাথমিক অবস্থায় যদি ধরা পড়ে তাহলে কটারি (একধরনের ইলেট্রিক যন্ত্র)-এর মাধ্যমে ঘষে দিলেও চিকিৎসা সম্ভব। আরেকটু বেড়ে গেলে ওই অংশটা কেটে ফেলে দিতে হবে। সর্বস্তরের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী সবাই যখন এই বিষয়টি অনুভব করবেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন এবং সরকার যখন এই কর্মসূচি নেবে তখন আর জরায়ু ক্যানসারে মানুষ এত বেশি মারা যাবে না। 


No comments:

Post a Comment